বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু
আজ ২১শে জুলাই, স্বাধীনতা অর্জনের সশস্ত্র লড়াইয়ে পুরুষের ছদ্মবেশে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
সবাইকে তীব্র শোকে ভাসিয়ে, গত বছর এই দিনে (২১শে জুলাই,২০১৬)
রাত ১ঃ৩০ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে তিনি মারা
গিয়েছিলেন।
আমাদের অমার্জিত ভুলে যাওয়ার চর্চার অন্যতম 'বলি' এই বীর
মুক্তিযোদ্ধা। মৃত্যু'র পর তাঁর বীরত্বগাঁথা তুলে এনে কতোটা লাভ হবে আমাদের
জানা নেই। তবুও, তাঁর বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা চেয়েই তাঁর কথা তুলে ধরার
চেষ্টা করছি।
![]() |
ছবিঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল (ডানে) প্রিয় সুহৃদ রিয়া মোমিনের সাথে |
দু'লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে এই
বার্তাটির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নারীর অবদান কোনভাবেই প্রতিফলিত
হয়না। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নারীর অবদান অনির্ণেয় ও অসীম।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নারী কখনো গেরিলা যুদ্ধে ,কখনও সম্মুখ যুদ্ধে ,কখনো
সেবিকা ,কখনো বার্তাবাহক হিসেবে অবদান রেখেছেন। অনেক নারী শহীদ
হয়েছেন,অনেকে তাদের স্বামী,সন্তান,বাবা,ভাই হারিয়েছেন। তাঁদের সকলের
সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ । অথচ, তাঁদের
উজ্জ্বলতম অবদান স্বীকার করতেই আমাদের যতো কৃপণতা।
মুক্তিযুদ্ধে অসামন্য অবদান রাখা মহিয়সী এই মানুষটি'র জন্ম,
১৯৫১ সালের ২রা সেপ্টেম্বর পাবনা জেলায়। বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ও
মা সেলিনা বানু। বাবা ছাত্রজীবনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মা
পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের এমপি
ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়ায় নিজেও ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ছোটবেলা
থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যোগ দেন তিনি।
মিতিলের দুই চাচাতো ভাই জিন্দান ও জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে
রওনা হয় তাদের মায়ের নির্দেশে৷ এই মায়ের কথা না বললেই নয়৷ তিনি তাঁর
ছেলেদের বলতেন, ‘তোমাদের কি মানুষ করেছি ঘরে থেকে অসহায়ভাবে মরার জন্য?
মরতে হলে যুদ্ধ করতে করতে মরো৷'' তিনি ছিলেন পাবনা মহিলা পরিষদের আহ্বায়ক
কমিটির সভানেত্রী রাকিবা বেগম ৷ এমন পরিস্থিতিতে মিতিলও ঘরে বসে থাকেননি৷
শার্ট প্যান্ট পরে কিশোর যোদ্ধা সেজে যুদ্ধে অংশ নেন৷
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের
বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এছাড়াও ১৯৭০-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত
পাবনা জেলা ছাত্রইউনিয়নের সভানেত্রী এবং কিছু সময়ের জন্য পাবনা জেলা মহিলা
পরিষদের যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য স্থানের মত পাবনা জেলাও
পাকিদের আক্রমনের হয়। সাধারন মানুষের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার।
২৭শে মার্চ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ ।২৭শে মার্চ
পাবনা পুলিশলাইনে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয় সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। তাই
নারী হয়ে শত প্রতিকুলতার মাঝে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহনের সিদ্ধান্ত গ্রহন
করেন। জিঞ্জিরের কাছে মাত্র ত্রিশ মিনিটে থ্রি নট থ্রি চালনা শিখে ফেলেন।
কিন্তু নারী হিসেবে সে সময়কার সমাজে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া ছিল খুবই কঠিন
ব্যাপার । তাই তিনি বীরকন্যা প্রীতিলতাকে অনুসরন করে পুরুষের পোশাক পরিধান
করে পুরুষবেশে যুদ্ধে যোগ দেন।
২৮ মার্চ শহরের জেল রোডে টেলিফোন ভবনে দখলদার ৩৬ জন
পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে যুদ্ধ হয়৷ যুদ্ধে পাক সেনাদের সবাই মারা পড়ে৷ দু'জন
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন৷ এভাবে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতেই থাকে৷ তখন যুদ্ধ চলছিল
নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরে৷ এছাড়াও ৩১শে মার্চ পাবনার পলিটেকনিক
ইনস্টিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। ৯ এপ্রিল নগরবাড়িতে এক প্রচণ্ড
যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় আকাশপথে৷ পাশের জেলা
কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে৷ তাদের বিভিন্ন দল পিছিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার
দিকে৷ পাবনার ছাত্রনেতা ইকবালের দল একটি গাড়িতে করে কুষ্টিয়া হয়ে
চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হয়৷ গাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মিতিল ও তাঁর এক
ভাই থেকে যায় কুষ্টিয়ায়৷ পরে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার সময় ভারতীয়
সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎ হয়৷ এরপর ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক
মানস ঘোষ মিতিলের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপেন৷ ফলে ছেলে সেজে যুদ্ধ করার আর
সুযোগ পাননি মিতিল৷
এরপর আরো প্রশিক্ষণের জন্য ভারত চলে যান এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ
সময়ে নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে
কিছুদিন৷ প্রথমে কয়েকজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে
যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করেন৷ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি৷ অবশেষে ৩৬ জন
নারী নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়৷ আস্তে আস্তে সদস্য সংখ্যা
বেড়ে যায়৷ এক পর্যায়ে সদস্য ছিল ২৪০ এর ওপরে৷ সেখানে প্রশিক্ষণ নেন তিনি৷
পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতে
থাকেন৷ অস্ত্রের অভাব থাকায় মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব
ছিল না৷ তাই প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিক্যাল কোরের সদস্য
হিসেবে৷ বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন৷
দুঃসাহসী এ মুক্তিযোদ্ধার অবদান ও সাহসিকতা সর্বজন স্বীকৃত।
মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ও অবদান নিয়ে কোন প্রশ্ন না থাকলেও,
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অজুহাতে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রাখা হয়েছে তার
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থগিত করে রাখা হয়েছে তার নাম।
পাবনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কিত প্রায় প্রতিটি গ্রন্থ ও
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণায় তার গৌরবগাঁথা উচ্চারিত হলেও অজ্ঞাত কারণে
জেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়নে সংযুক্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই তার নাম ও
অবদানের কথা।
রাষ্ট্র যদি বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরীন বানু মিতিল'কে তাঁর
অর্জিত সম্মানটুকু নাও দেয়, আমাদের আক্ষেপ নেই। শিরীন বানু মিতিল'রা খেতাব
অর্জনের লোভে বা মৃত্যুর পর 'ভেঁপু'র শব্দে দাফনের জন্য যুদ্ধে যাননি।
পরম করুনাময় তাঁর চিরশান্তির স্থানে আপনাকে আসীন করুন।
বিদায়, হে বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানের দুর্বৃত্ত সময়ে আপনার
চলে যাওয়া বড় বেশী কষ্টের। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর মতো শোকাবহ দিনে আপনাকে
স্মরণ করি, আর্দ্র হৃদয়ে, ভালোবাসা আর গভীর শ্রদ্ধায়।
No comments